হাফিজ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

হাফিজ একজন ইরানী কবি যাকে বুলবুল-ই-শিরাজ বলা হয়। শিরাজ ইরানের মদিনা,পারস্যের তীর্থভূমি। শিরাজেরই মোসল্লা নামক স্থানে বিশ্ববিশ্রুত কবি হাফিজ চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে জন্মগ্রহণ করেন। ইরানের এক নিশাপুর(ওমর খৈয়াম-এর জন্মভূমি) ছাড়া আর কোন নগরই শিরাজের মত বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেনি। ইরানের প্রায় সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিরই লীলা-নিকেতন এই শিরাজ।ইরানীরা হাফিজকে আদর করে "বুলবুল-ই-শিরাজ" বা শিরাজের বুলবুলি বলে সম্ভাষণ করে।হাফিজকে তারা শুধু কবি বলেই ভালোবাসে না। তারা হাফিজকে "লিসান-উল-গায়েব"(অজ্ঞাতের বাণী),"তর্জমান-উল-আসরার"(রহস্যের মর্মসন্ধানী) বলে আরো বেশী শ্রদ্ধা করে। হাফিজের কবর আজ ইরানের শুধু জ্ঞানী-গুণীজনের শ্রদ্ধার স্থান নয়, সর্বসাধারণের কাছে "দর্গা", পীরের আস্তানা।

হাফিজের মৃত্যুর একশত বছরের মধ্যে তাঁর কোন জীবনী রচিত হয়নি। কাজেই তাঁর জীবনের অধিকাংশ ঘটনাই আঁধারের নীল মঞ্জুষায় চির-আবদ্ধ রয়ে গেছে। তাঁর জন্ম-মৃত্যুর দিন নিয়ে ইরানেও তাই নানা মুনির নানা মত। হাফিজের বন্ধু ও তাঁর কবিতাসমূহের(দীওয়ানের) মালাকর গুল-আন্দামের মতে হাফিজের মৃত্যু-সাল ৭৯১ হিজরি বা ১৩৮৯ খ্রীষ্টাব্দ। কিন্তু তিনিও কবির সঠিক জন্ম-সাল দিতে পারেননি।

হাফিজের পিতা বাহাউদ্দীন ইসপাহান নগরী হতে ব্যবসা উপলক্ষে শিরাজে এসে বসবাস করেন। তিনি ব্যবসায়ে বেশ সমৃদ্ধিও লাভ করেন, কিন্তু মৃত্যুকালে সমস্ত ব্যবসা এমন গোলমালে জড়িয়ে রেখে যান যে, শিশু হাফিজ ও তাঁর জননী ঐশ্বর্যের কোল থেকে একেবারে দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে পতিত হন। বাধ্য হয়ে তখন হাফিজকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থোপার্জন করতে হয়। কোন কোন জীবনী-লেখক বলেন, দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে হাফিজকে তাঁর জননী অন্য একজন সঙ্গতিসম্পন্ন বণিকের হাতে সমর্পণ করেন। সেখানে থেকেই হাফিজ পড়াশুনা করার অবকাশ পান। যেভাবেই হোক, হাফিজ যে কবি-খ্যাতি লাভ করার আগে বিশেষরূপে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, তা তাঁর কবিতা পড়েই বোঝা যায়।

হাফিজের আসল নাম শামসুদ্দিন মোহাম্মদ। "হাফিজ" তাঁর "তখল্লুস", অর্থাৎ কবিতার ভণিতায় ব্যবহৃত উপ-নাম। যারা সম্পূর্ণ কোরান কণ্ঠস্থ করতে পারেন, তাঁদের মুসলমানেরা "হাফিজ" বলেন। তাঁর জীবনী-লেখকগণও বলেন, হাফিজ তাঁর পাঠ্যাবস্থায় কোরান কণ্ঠস্থ করেছিলেন।

তাঁর পাঠ্যাবস্থায়ই তিনি স্বভাবদত্ত শক্তিবলে কবিতা রচনা করতে আরম্ভ করেন, কিন্তু তা তেমন আদর লাভ করতে পারেনি। কিছুদিন পরে "বাবা-কুহী" নামক শিরাজের উত্তরে পর্বতের উপরকার এক দর্গায়(মন্দিরে) ইমাম আলি নামক এক দরবেশের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সেদিন "বাবা-কুহী"তে রাতভর ধর্মোৎসব চলছিল। হাফিজও ঐ উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। ইমাম আলি হাফিজকে রহস্যময় কোন স্বর্গীয় খাবার খেতে দেন এবং বলেন, এর পরই হাফিজ কাব্যলক্ষীর রহস্যপুরীর সব ঐশ্বর্যের অধিকারী হবে। এতে কতটা কল্পনারস মিশে আছে তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও, এটা সত্য যে, হাফিজের সমস্ত জীবনী-লেখকই এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। শুধু উল্লেখ নয়, বিশ্বাসও করেছেন।

হাফিজ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কবিতাসমূহ(দীওয়ান) সংগ্রহ করে যাননি। তাঁর বন্ধু গুল-আন্দামই সর্বপ্রথম তাঁর মৃত্যুর পর "দীওয়ান" আকারে হাফিজের সমস্ত কবিতা সংগ্রহ ও সংগ্রথিত করেন। কাজেই - মনে হয়, হাফিজের পঞ্চশতাধিক যে কবিতা আমরা পেয়েছি, তাছাড়াও অনেক কবিতা হারিয়ে গেছে, বা তিনি সংগ্রহ করতে পারেননি।

হাফিজ ছিলেন উদাসীন সুফী। তাঁর নিজের কবিতার প্রতি তাঁর মমতাও তেমন ছিল না। তাই কবিতা লিখবার পরই তাঁর বন্ধুবান্ধব কেউ সংগ্রহ না করে রাখলে তা হারিয়ে যেত। কিন্তু তাঁর কবিতার অধিকাংশই গজল-গান বলে, লেখা হওয়ামাত্র মুখে মুখে গীত হত। ধর্মমন্দির থেকে শুরু করে পানশালা অব্দি সবখানেই তাঁর গান আদরের সাথে গীত হত।

হাফিজ সম্বন্ধে বিশ্ববিজয়ী বীর তৈমুরকে নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। হাফিজের কবিতার এই দুটি চরণ ততদিনে জগদ্বিখ্যাত হয়ে গেছে---

                                 "যদিই কান্তা শিরাজ-সজনী ফেরৎ দেয় মোর চোরাই দিল ফের
                                  সমরকন্দ ও বোখারায় দিই বদল তার লাল গালের তিলটের!"

সেই সময় তৈমুরের সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল সমরকন্দ। হাফিজ তাঁর প্রিয়ার গালের তিলের জন্য তৈমুরের সাম্রাজ্যের রাজধানী বিলিয়ে দিতে চান শুনে তৈমুর ভীষণ ক্রোধান্বিত হয়ে পারস্য জয়ের সময় হাফিজকে ডেকে পাঠান। উপায়ন্তর না দেখে হাফিজ তৈমুরকে বলেন যে তিনি ভুল শুনেছেন, শেষের চরণের "সমরকন্দ ও বোখারা"র পরিবর্তে "দো মণ কন্দ ও সি খোর্মারা" হবে। "আমি তার গালের তিলের বদলে দু মণ চিনি ও তিন মণ খেজুর দান করব!"

কেউ কেউ বলেন, হাফিজ এই উত্তর দেননি। তিনি নাকি দীর্ঘ কুর্নিশ করে বলেছিলেন, "সম্রাট! আমি আজকাল এই রকমই অমিতব্যয়ী হয়ে পড়েছি!" এই জবাব শুনে তৈমুর এত আনন্দ পান যে, শাস্তি দেয়ার বদলে হাফিজকে তিনি বহুমূল্য পারিতোষিক দেন। হাফিজের নামে এরকম অনেক গল্প চালু আছে, যার বেশীরভাগই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

হাফিজের প্রায় সব কবিতা "শাখ-ই-নবাৎ" নামক কোনো ইরানী সুন্দরীর স্তবগানে মুখরিত। অনেকে বলেন, "শাখ-ই-নবাৎ" হাফিজের দেয়া আদরের নাম। তার আসল নাম হাফিজ গোপন করে গেছেন। কোন্ ভাগ্যবতী এই কবির প্রিয়া ছিলেন, কোথায় ছিল তার কুটির, এ নিয়ে অনেকে অনেক জল্পনা-কল্পনা করেছেন। রহস্য-সন্ধানীদের কাছে এই হরিণ-আঁখি সুন্দরী আজো রহস্যের আড়ালে রয়ে গেছেন।

হাফিজ যৌবনে হয়ত শারাব-সাকির উপাসক ছিলেন, তবে পরে যে তিনি সুফী-সাধকরূপে দেশ ও দশের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন তা প্রত্যেক ইরানীই বিশ্বাস করে।

তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে একটি বিস্ময়কর গল্প প্রচলিত আছে। শিবলী নোমানী, ব্রাউন সাহেব প্রভৃতি পারস্য সাহিত্যের সকল অভিজ্ঞ সমালোচকই এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন।

হাফিজের মৃত্যুর পর একদল লোক তাঁর 'জানাজা' পড়তে (মুসলমানী মতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে) ও কবর দিতে অসম্মতি জানায়। হাফিজের ভক্তদলের সাথে এ নিয়ে বিসম্বাদের সৃষ্টি হলে কয়েকজনের মধ্যস্থতায় উভয় দলের মধ্যে এই শর্তে রফা হয় যে, হাফিজের সমস্ত কবিতা একত্র করে একজন লোক তার যে কোন স্থান খুলবে; সেই পৃষ্ঠায় প্রথম দুই চরণ কবিতা পড়ে হাফিজের কি ধর্ম ছিল তা ধরে নেয়া হবে।

আশ্চর্যের বিষয়, এভাবে এই দুই চরণ কবিতা পাওয়া গেছিল ---

                                     "হাফিজের এই শব হ'তে গো তু'লো না কো চরণ প্রভূ 
                                      যদিও সে মগ্ন পাপে বেহেশতে সে যাবে তবু।"

এর পর উভয়দল মিলে মহাসমারোহে হাফিজকে এক দ্রাক্ষাকুঞ্জে সমাহিত করেন। সে স্থান আজও "হাফিজিয়া" নামে প্রসিদ্ধ। দেশ-বিদেশ হতে লোক এসে আজও কবির কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে।

হাফিজ পারস্য ছেড়ে কখনো কোথাও যাননি। স্বদেশ ও স্বপল্লীর প্রতি তাঁর অণু-পরমাণুতে অপূর্ব মমতা সঞ্চিত ছিল। বহু কবিতায় তাঁর বাস-পল্লী "মোসল্লা" এবং "রোকনাবাদে"র খালের প্রশংসা দেখতে পাওয়া যায়।

হাফিজ নিজের সম্বন্ধে বলে গেছেন ---

                             "আমার গোরের পার্শ্ব  দিয়া যেতে চেয়ো আশিস্ তুমি
                              এ গোর হবে ধর্ম-স্বাধীন নিখিল-প্রেমিক-তীর্থভূমি।"

আজ সত্যই হাফিজের কবর নিখিল-প্রেমিকের তীর্থভূমি হয়ে উঠেছে।

উৎসঃ কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর অনুবাদমূলক গ্রন্থ রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ থেকে সংকলিত